ফেসবুক বন্ধ : ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্স ব্যবসায় ধ্বস

    fb bandoবাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার পর থেকে ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্স ব্যবসায় বড় ধরণের ধস নেমেছে। ব্যবসা কমেছে মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্র্যান্ডউইথ ব্যবসায়ীদেরও। নিরাপত্তার ইস্যুতে ফেসবুক বন্ধ করা হলেও কবে তা খুলে দেওয়া হবে তা বলতে পারছে না কেউ। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কাছে এই মুহূর্তে ফেসবুকে খুলে দেওয়ার কোন নির্দেশনা নেই বলে জানানো হচ্ছে। ফলে দেশের অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ সময় ধরে চরম সংকটে দিন কাটাতে হচ্ছে।  সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারী ১ কোটি ৭০ লাখ। এই বিশাল কমিউনিটির ওপর নির্ভর করে দেশে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার অনলাইন ব্যবসা। কিন্তু ফেসবুক বন্ধ হওয়ার কারণে এখন তাদের ব্যবসায় বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বিকল্প পথে ফেসবুক ব্যবহার করলেও সেখানে কোন সাড়া পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন। আবার ঢাকার বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুলে দেওয়ার জন্য ফ্রিল্যান্সারদের মানববন্ধ করারও খবর পাওয়া গেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেছে দিনাজপুর ফ্রি ল্যান্সার অ্যাসোসিয়েশন। সোমবার দুপুর ১২ টায় তারা দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার কারণে অনলাইন ব্যবসায় যে প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে কয়েক দফায় প্রতিবেদন করেছে বিবিসি বাংলা। তাদের প্রতিবেদনে সারা দেশের কিছু চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের নিয়মিত অর্ডার পায়।
    সরকারী নির্দেশে গত ছয়দিন ধরে ফেসবুক বন্ধ থাকায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেরই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ধস নেমেছে বলে জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁর উদ্যোক্তা শুচিস্মিতা বোস নিজের একটি ছোট বুটিক চালান। সেই সাথে গত বছরখানেক ধরে তিনি কল্কা ডট কম নামে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে টেইলারিং এর কাজ করছেন। এই অনলাইন অর্ডারের একটি অংশ আসে ফেসবুক থেকে, সরকারী নির্দেশের কারণে গত কয়েকদিন ধরেই যেটি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফেসবুকে যে অর্ডার আমি পাই, সেটি হয়ত অনেক টাকার অর্ডার না। কিন্তু যেটাই আসত তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে গত ছয়দিন ধরে। বিবিসির আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরকারী নির্দেশে এক সপ্তাহ ধরে ফেসবুক বন্ধ রাখার কারণে জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের অনেকে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে শুরু করেছেন। ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করেন এমন অনেকে অভিযোগ করছেন যে তাদের ব্যবসা মোটামুটি বসে গেছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের যেসব পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ বাংলাদেশীর নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর এদের প্রায় অর্ধেক বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর কোঠায়। আর এদের টার্গেট করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডও চালাচ্ছে।  দেশের অনলাইনে সংবাদ পরিবেশনকারীরা বলছেন, ফেসবুক না থাকার কারণে তাদের পেজে ভিজিটরের সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে। বেসরকারী টেলিভিশন এনটিভি’র অনলাইনের দায়িত্বে রয়েছেন ফখরুদ্দিন জুয়েল, তার কথায়, “আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমাদের ট্রাফিক কমে যাচ্ছে। খুব সহজ একটি যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবহার খুব দ্রুত বেড়েছে। এর ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন তাদের সাড়ে ৪শ’ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হতো।
    এখন ফেসবুক বন্ধের পর ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ৩শ’ টেরাবাইটের নিচে নেমে এসেছে। গ্রামীণফোনের হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসাইন বলেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগ সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন। এটি একটি খুবই জনপ্রিয় অ্যাপস। এটি বন্ধ থাকার ফলে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার কমাটাই স্বাভাবিক। ফলে অন্য গ্রাহকরা ব্রাউজিংয়ে গতি বেশি পাচ্ছেন। এদিকে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সভাপতি এম এ হাকিম বলেছেন, গত বুধবার ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হওয়ার পর প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যান্ডউইথের ব্যবহার কমে গেছে। এদিকে ভারতের ইন্ডিয়া টাইমস নামের একটি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে ৩০% ইন্টারনেট ব্যবহার কমেছে।  ফেসবুক বন্ধ হওয়ার পর অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের দিন খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আইটি ইন্ডাস্ট্রির কেউ কোন কথা বলচ্ছেন না বলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফ্রিল্যান্সার তানভীর রেজওয়ান বলেছেন, আইটি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের মোটামুটি অনেক গুলো সংগঠন আছে বাংলাদেশে। আইটি জার্নালিস্টদেরও একটা সংগঠন আছে। এছাড়াও টেক রিলেটেড গ্রুপগুলো আর সংগঠন গুলোর হাকডাকে এমনি সময়ে অনলাইনে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। কেউ বাংলাদেশের জেলায় জেলায় সিলিকন ভ্যালী বানায় তো আবার কেউ ঘরে ঘরে আলীবাবা-আমাজনের জোয়ার বইয়ে দেয়। কেউ দেশের সবাইকে উদ্যোক্তা বানিয়ে দেয় আবার কেউ দিনে-দিনে লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার পয়দা করে। কিন্তু যারা নিজেদেরকে বাংলাদেশের টেক ইন্ডাস্ট্রির মহান ত্রানকর্তা ও বাতিঘর বলে দাবী করেন, তাদের কি ধারনা নেই এই মিডিয়াগুলো বন্ধ থাকার কারণে কতগুলো মানুষের পেটে লাথি পড়ছে?
    কতগুলো উদ্যোগ শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে? আপনারা কি চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও কোন উদ্যোগ নিবেন না? প্রায় একই ধরণের কথা বলেছেন কক্সবাজার ই-শপের মালিক লিটন দেবনাথ সরকার। তিনি বলেছেন, একটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করছি কয়েকদিন ধরে। ফেসবুক নির্ভর তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে লাফালাফি করা ডান-বাম-মধ্যপন্থি কোন সংগঠন, গ্রুপ, ব্যাক্তি ফেসবুক ইস্যুতে কোন বাণী ছাড়ছে না। ব্যাপার কি কেউ বলবেন? ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব জি রাহুল জানিয়েছেন, ফেসবুক বন্ধ হওয়ার কারণে আমার নিয়মিত অর্ডার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এটা আমার ব্যবসার জন্য অনেক বড় লস। এ ব্যাপারে কে দায়িত্ব নেবে? ‘সৌহাদ্য ফ্যাশন’-এর এডমিন সম্পি জানান, আমাদের মতো অনেক নারীই ক্ষুদ্র আঙ্গিকে ঘরে বসে পণ্য তৈরি করে ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। কিন্তু ফেসবুক বন্ধ করায় তারা হঠাৎ করে ক্ষতিতে পড়ছেন। তিনি বলেন, আমরা এই কয়দিনে নিজেদের নতুন পণ্যের যেমন প্রচারণা চালাতে পারছি না, অন্যদিকে কোনো পণ্যের অর্ডারও পাচ্ছি না। ফ্রিল্যান্সার সোহেল বলেছেন, ইন্টারনেটের স্পিড নাই্, পেজ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছে। ফেসবুকের মাধ্যমে যারা ইনকাম করে তাদের কোন ইনকাম নাই এখন। আমার ২ ঘন্টার কাজ এখন ৩ ঘন্টা লাগছে। অফিসের কাজের স্পিড এখন ৩ ভাগের ২ ভাগে নেমে এসেছে। ফেসবুকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষও তাদের নতুন নতুন অফারের প্রচার করে থাকেন। কিন্তু কদিন ধরে তা বন্ধ থাকায় তারা নিজেদের খাবার সম্পর্কে আপডেট দিতে পারছেন না। এতে রেস্টুরেন্টগুলোর রাজস্ব আদায় কমে গেছে। আশানুরূপ ক্রেতা না পাওয়ায় ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে।
    ‘স্ট্রিট বারবিকিউ’ নামে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক মইনুল হাসান জানান, ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে তাদের আগে যে রাজস্ব আদায় হতো- এখন তা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। তাদের ক্রেতারা আগে যেখানে ফেসবুকের আপডেট দেখে এখানে খেতে আসতেন, এখন তা সম্ভব না হওয়ায় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  এ ব্যাপারে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি রাজীব আহমেদ বলেন, ‘ফেসবুক বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ ফেসবুকের কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই। সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য এটি বন্ধ করেছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অর্থনীতির কথা চিন্তা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন এটা খুলে দেয়া হয়। তা না হলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই বেকার হয়ে যেতে পারেন।’ ই-ক্যাবের যুগ্ম-সম্পাদক রেজওয়ানুল হক জামির বলেন, এ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের ই-কর্মাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ব্যবসা করেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ ব্যবসায়ী। ফেসবুক বন্ধ থাকায় তাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। জামি আরও বলেন, বাংলাদেশে ই-কমার্স সাইট রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টি। তাদের প্রোডাক্ট বিক্রির মূল মাধ্যম ছিল ফেসবুক মার্কেটিং। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা ক্রেতাদের বিভিন্ন ধরনের অফার দিতেন, যোগাযোগ করতেন, অর্ডারও পেতেন। ই-ক্যাবের জানা মতে, এ সব ই-কমার্সের সাইটের অর্ডার প্রায় ৪৫% কমে গেছে।  বাংলাদেশের প্রায় ৪ লাখ ছেলেমেয়ে আউট সোর্সিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ করেন এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নিয়ে আসেন। বিদেশে ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের প্রধান কয়েকটি মাধ্যম হচ্ছে, ভাইবার, হোয়াটসআপ ও ফেসবুক। কারণ, এ সমস্ত কাজের জন্য খুব ঘনঘন বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়।
    রেজওয়ানুল হক জামি জানালেন, এ সব যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকায় বিদেশি অর্ডারের পরিমাণ কমে ৬৫%-এ নেমে এসেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এসব বন্ধ থাকলে এ খাতে ধস নামবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি হিসাবের তথ্য ধরে জামি বললেন, ই-কমার্সে প্রতি মাসে ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সে হিসাবে গত ৬ দিনে এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তবে, অনলাইন ভিত্তিক কৃষি পণ্যের ওয়েবসাইট ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’ বলছে, ফেসবুক বন্ধ থাকায় তাদের বিক্রিতে তেমন প্রভাব পড়েনি। প্রতিষ্ঠানের প্রধান সাদেকা হাসান বলছেন, ফেসবুক নির্ভরশীলতা কম থাকার কারণে এটি হয়েছে। “এটা আসলে আমাদের এ খাতের সবার জন্য একটা শিক্ষা। চীনে তো ফেসবুক বন্ধ, তাহলে নতুন একজন উদ্যোক্তা সেটিকে টার্গেট করে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা না করাই উচিত।” তবে, মিজ হাসান বলছেন ইন্টারনেটের গতি কম হওয়ায় ডিজিটাল পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

    *

    Post a Comment (0)
    Previous Post Next Post