‘দখিন দুয়ারি ঘরের রাজা, পূব দুয়ারী তাহার প্রজা।
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই, উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।’
পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই বিপুল জনসংখ্যা কে সামাল দিতে গিয়ে সমানতালে বেড়ে চলেছে শিল্প-কলকারখানা-আবাসন। সেই সাথে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবীর জলবায়ু। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির যুগে সচেতন মানুষ মাত্রই গ্রীন হাউস গ্যাস বা গ্রীন হাউস ইফেক্ট সম্পর্কে কম-বেশী অবগত। বিশ্বের বড় বড় নামকরা বিজ্ঞানীগণ এই বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে মুক্তি উপায় নিয়ে চিন্তা করে চলেছেন প্রতি নিয়ত। প্রকৌশলীরাও এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক মুক্তি পথের সন্ধানে খুব একটা পিছিয়ে নেই। পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণের ব্যাপারে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে সেই ১৯৭০ সাল থেকে। এই পরিবেশবান্ধব ভবনের একটি সুন্দর নামও দেয়া হয়েছে। এই ধরণের ভবনকে প্রকৌশলীগণ আদর করে গ্রীন বিল্ডিং বা সবুজ ভবন নামে ডেকে থাকেন। সবুজ ভবনের ধারণাটি মূলত জ্বালানীর অপচয়-অপব্যবহার রোধ এবং ভবনটিকে পরিবেশের সাথে মানানসই করবার একটি প্রয়াস।
একটি ভবনকে সবুজ ভবন হিসাবে বিভিন্ন ভাবে নির্মান করা যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন স্থপতি-প্রকৌশলী-বাড়ির মালিকের ঐকান্তিক সদিচ্ছা, এক ও অভিন্ন মানসিকতা। পৃথিবীকে পরবর্তি প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যাবার আগ্রহ থেকেই সূচিত হয়েছে সবুজ ভবনের ধারণা। এই ধারণার শুরুতে আমরা একটি ভবনের জীবন-চক্রের দিকে আলোকপাত করতে পারি। ‘জমি অধিগ্রহণ’ থেকে শুরু হয় ভবনের জীবন-চক্রের যাত্রা। আর শেষ হয় ‘ধ্বংস করে নতুন ভবন নির্মাণের চিন্তা’ এর মাধ্যমে। এই দুই পর্যায়ের মাঝে আরও কিছু পর্যায় আছে যা নিচে চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল।
[চিত্রঃ ভবনের জীবন-চক্র]
জীবন-চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে ভবন কে একটি আদর্শ সবুজ ভবন হিসাবে নির্মাণ করা যায়। প্রথমত, জমি অধিগ্রহনের বিষয়টিই বিবেচনা করা যাক। জমি অধিগ্রহনের শুরুতে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যেন বনায়ন ধ্বংস করে বা উর্বর জমি নষ্ট করে ভবনটি তৈরি না হয়। অর্থ্যাৎ ভবন তৈরির জন্য অনুর্বর-পতিত জমি নির্ধারণ করা খুবই জরুরী।
দ্বিতীয়ত, ভবনের নকশা প্রনয়ণ পর্যায়টি যেকোন ভবন নির্মাণের পূর্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ পর্যায়ে সবুজ ভবনের ধারণা মাথায় রাখা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। নকশা প্রনয়ণের সময়টিতে মনে রাখতে হবে যেন ভবনটি উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম হিসাব করে নকশা করা হয় এবং সেই সাথে ভবনের জানালা-দরজার প্রশস্ততা ও উচ্চতা সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়। দিক হিসাব করে কোন ভবন নকশা করলে ভবনটির প্রতিটি ঘর খোলামেলা হয় এবং ঘরের ভিতর প্রচুর আলো-বাতাস চলাচল করে। যার ফলে ঘরটিকে অযথা কৃত্রিমভাবে আলোকিত করবার অথবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎব্যবস্থার উপর চাপ অনেকটাই কম পড়বে এবং তার সাথে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার কম হবে। বর্ষাকাল ছাড়াও আমাদের দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন ঋতুতে বেশ ভাল পরিমান বৃষ্টিপাত হয়। প্রকৌশলীগণ এই বৃষ্টির পানি কে সংরক্ষন করে টয়লেটে ফ্ল্যাশ ও অন্যান্য বাহ্যিক কাজে (যেখানে বিশুদ্ধপানির প্রয়োজন নেই) ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয় গোসল বা হাত-মুখ ধোয়ার পর পরিত্যাক্ত পানিকেও একইভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে ভুগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যাবে। এই প্রযুক্তিটি অবশ্য বহু পূর্বে মোঘল স্থাপত্যের বিভিন্ন ভবনে দেখা যায়। প্রকৌশলীগণ এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারের মাধ্যমে সবুজ ভবন নির্মাণে আরও একধাপ গিয়েছেন।
একটি ভবনের জীবন-চক্রের তৃতীয় ধাপ হল নির্মাণকালীন পর্যায়। এ পর্যায় কে সাফল্যমন্ডিত করতে অর্থ্যাৎ সাদামাটা একটি ভবন কে সবুজ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলীগন নিরন্তরভাবে সবুজ উপাদানের খোজ করে চলেছেন। ভবন তৈরি করতে যেসব সবুজ উপাদান সাধারণত ব্যবহারের জন্য প্রকৌশলীগন পরামর্শ প্রদান করে থাকেন, সেসব উপাদানগুলোর বৈশিষ্ঠ্য নিচে আলোচনা করা হলঃ
- ভবনে ব্যবহৃত কাচামাল কে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব হতে হবে। অর্থ্যাৎ কাচামালটিকে এমন হতে হবে যেন সহজে প্রাকৃতিকভাবে আহরণ করা যায় এবং আহরণের কারণের পরিবেশের বিশেষ ক্ষতি যেন না হয়।
- ভবন নির্মাণের উপাদান যতবেশি পরিমানে পুনর্ব্যবহার করা যাবে ততই পরিবেশের উপর চাপ কম পড়বে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লীন কঙ্ক্রীট বা সিসি ঢালাই ভবনের কোন স্ট্রাকচারাল অংশ নয়, সুতরাং এই লীন কঙ্ক্রীট ঢালাইয়ের উপাদান হিসাবে ভবন নির্মাণের সময় প্রাপ্ত রাবিশ বা অন্যান্য ভাঙ্গা কঙ্ক্রীটে টুকরা ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে নতুন উপাদান আহরণ করার প্রয়োজন হবেনা। অতিরিক্ত জ্বালানী ও শক্তির অপচয় রোধে সম্পদের পুনর্ব্যবহার খুবই জরুরী।
- নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত উপাদান স্থানীয়ভাবে সংগ্রহযোগ্য হতে হবে যাতে একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের সময় কম পরিমান জ্বালানীর প্রয়োজন হয়।
- অশোধিত কাচামাল কে ভবন তৈরির উপযুক্ত উপাদানে রূপান্তরিত করতে জ্বালানীর অপচয় কম হতে হবে। অশোধিত কাচামাল কে নির্মাণোপযোগি উপাদানে উন্নীত করতে যত কম পরিমান জ্বালানী শক্তি ব্যয় হবে, তত কম পরিমান কার্বন পুড়বে, ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
- নির্মাণ উপাদান ব্যবহারের ফলে ঘরের ভেতরকার বাতাসের গুনগতমান যেন অটুট থাকে, এই ধরণের উপাদান যেন বেশী পরিমান আর্দ্রতা শোষণ না করে এবং ঘরে বসবাসরত মানুষদের যাতে স্বাস্থ্যহানি না হয় সেদিকটাতেও প্রকৌশলীগণ নজর দিয়েছেন। অনেকসময় দেখা যায়, ঘরের দেয়াল ও কাঠের উপর রং-বার্ণিশ এবং ঘরের ভিতর ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের উপাদান একধরণের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে থাকে। এই ধরণের গ্যাস কে ভি,ও,সি (ভোলাটাইল অরগানিক কম্পাউন্ড) বলা হয়ে থাকে। আবার অন্যদিকে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরণের কাঠ বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে থাকে, এই আর্দ্রতা ওই ধরণের কাঠে উইপোকা ও নানান ধরণের অনুজীব জন্মাতে সাহায্য করে থাকে, যা ঘরে বসবাসরত মানুষের স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ।
- সর্বপরি ভবনের কাজে যে উপাদানটি ব্যবহার করা হবে সেটি যেন অবশ্যই টেকসই ও কম মূল্যের হতে হবে। যাতে ঘন ঘন বদলাবার প্রয়োজন না হয় ও সব ধরণের জনগোষ্ঠি কম খরচে ব্যবহার করতে পারে।
[চিত্রঃ একটি আদর্শ সবুজ ভবনের লম্বচ্ছেদ; সূত্রঃ ইন্টারনেট]
একটি ভবনের জীবন-চক্রের সবচেয়ে শেষের পর্যায়টি হল ভবনটি ধ্বংস করে নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা। এখানেও আমরা ভবনটি কে সুন্দরভাবে, পরিকল্পিত উপায়ে, পরিবেশের ক্ষতি না করে এবং কম পরিমান শক্তি ব্যবহার করে ভেঙ্গে ফেলতে পারি। এজন্য বর্তমানে প্রকৌশলীগণ নানা ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন যাতে করে একটি ভবন সম্পূর্ণ সবুজ পদ্ধতিতে ভেঙ্গে ফেলা যায়।
সবুজ ভবন নির্মাণ করতে হলে ভবন নির্মাণের প্রতিটি মূহুর্তে-প্রতিটি কর্মকান্ডে-প্রতিটি উপাদানে-প্রতিটি যন্ত্রপাতিতে সবুজের হাতছানি থাকাটা খুব জরুরী। শুধুমাত্র সেকারণে সব কিছুতে সবুজের ছোঁয়া দেয়া যে কারো একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সবার সবুজ পৃথিবী গড়ার মানসিকতা, সবুজ উপাদান উৎপাদনের একান্ত ইচ্ছা এবং সবুজ ভবন নির্মাণের আন্তরিক প্রচেষ্টা। তাহলেই একেকটি সবুজ ভবন ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠবে একেকটি নিরাপদ আবাসস্থল। আর সেভাবে পৃথিবী হয়ে উঠবে পরবর্তি প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য ভুমি। কবি সুকান্তের ভাষায় বলি সেটাই হোক সবার দৃপ্ত অঙ্গীকার,
“চলে যাব– তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ–শিশুর বাসযোগ্য ক‘রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”